(১৩/ ০৯/ ২০১৭)
প্রিয় রাজ ভাই,
পত্র-সাহিত্য বলে বাংলা সাহিত্যের একটি ধারা ছিল, যা এখন বিলুপ্ত। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ইত্যাদি মনীষীদের পুস্তকাকারে প্রকাশিত পত্রাবলী পড়ে দেখেছি, স্বভাবসিদ্ধ বাগ্চাতুর্যের সঙ্গে ঘরোয়া সহজ-সরসতার মিশেলে সেই লিপিগুলি বড়ই সুপাঠ্য ছিল। দুঃখের বিষয় এই যে, নিতান্তই কেজো ‘বিজনেস লেটার’ ছাড়া, চিঠি আমরা আর লিখিনা; লাল ডাকবাক্স আর তকমা আঁটা পিয়নের উৎসুক প্রতীক্ষায় থাকার সেই দিনগুলি আমরা পিছনে ফেলে এসেছি, অথবা বলা ভাল তারাই অভিমানে আমাদের ছেড়ে দূরে সরে গেছে। আপনার সুলিখিত পত্রটি আমাকে সেই হারিয়ে যাওয়া সোনালী অতীতের কথা মনে করিয়ে দিল।
শীতলক্ষ্যা নামটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আমি ঠিক জানিনা। তবে প্রথম যখন এই নামটি শুনেছিলাম, আমি দেখতে পেয়েছিলাম শীতল এক আঁখিজোড়া। আয়তবিস্তৃত সকরুণ সেই নয়নযুগল যেন আমাকে আশ্রয় নিতে ডাকছে। আমার মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে যে নামটি আমার মনে আসে, তা হল শীতলক্ষ্যা। শীতলক্ষ্যারা চিরকালই আমাদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় দিয়ে এসেছে; আমাদের শান্ত করেছে, শীতল করেছে।
আপনার চিঠিটি পড়তে পড়তে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এক বিস্তীর্ণ নদীর দৃশ্য। কৃষ্ণবর্ণ নয়, কাকচক্ষু নির্মল তার জল। সকাল হচ্ছে, কুয়াশার জাল কেটে নবীন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। রাজহংসেরা গ্রীবা বাঁকিয়ে ভেসে চলেছে। চঞ্চল ছেলের দল জলে ঢেউ তুলে সাঁতার কাটছে, ঘাটে স্নান করতে এসেছে গ্রামবধূরা। নদীর বুকে ইতস্ততঃ ভাসছে বেশ কয়েকটি বহিত্র। চট্টগ্রাম, সপ্তগ্রাম, তাম্রলিপ্ত—বঙ্গদেশের প্রসিদ্ধ সব বন্দরনগর থেকে এসেছে সেগুলি। ছোটো ছোটো নৌকায় করে বহিত্রগুলিতে বোঝাই হচ্ছে বহুবর্ণের বিচিত্র সব পরিধান। এক হাতের মুঠোয় একটি প্রমাণাকার বস্ত্রখন্ডকে ভরে তার পেলবতা পরখ করে দেখছেন এক প্রবীণ শ্রেষ্ঠী। পাশে বসা তাঁর নবীন পুত্রের চোখে অপার বিস্ময়। পরিধেয় বস্ত্র এত সূক্ষ্ম হতে পারে! অভিজ্ঞ শ্রেষ্ঠী সন্তুষ্টিতে মাথা নাড়তে নাড়তে হাসছেন। এ হল পূর্বদেশের মসলিন। প্রত্যেকটি বস্ত্র বড় মূল্যবান। কয়েকটি তো অমূল্য। এই রত্নভান্ডার নিয়ে তিনি পাড়ি দেবেন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তাল সমুদ্র। লঙ্কাদ্বীপ, যবদ্বীপ, শ্যামদেশ, সুবর্ণভূমি – সর্বত্র সমাদর পায় এই আশ্চর্য বস্ত্র। পর্যাপ্ত স্বর্ণমুদ্রা পাবেন বিনিময়ে, সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত তিনি। তবে মনে তাঁর উত্তেজনা অন্য একটি কারণে। পরিচিত বাণিজ্যপথ ছেড়ে তিনি এবার পাড়ি দিতে চান নতুন সম্ভাবনার উদ্দেশ্যে। তিনি শুনেছেন, গান্ধার-পারস্য পেরিয়ে যে সুদূর পশ্চিমদেশ, সেখান থেকে জলপথে এসে ভারতভূমিতে উপনিবেশ স্থাপন করেছে কিছু শ্বেতকায় ধূসরচক্ষু নৌ-বণিক। মসলিন বস্ত্র, মাণিক্যের কণ্ঠহার, গজদন্তের পেটিকা--বহুরত্নপ্রসূ জম্বুদ্বীপের প্রত্যেকটি বিলাসদ্রব্য তারা আশাতীত মূল্যে ক্রয় করে, তারপর বিচিত্রদর্শন নৌ-যানগুলিতে বোঝাই করে সেসব তারা পাঠিয়ে দেয় তাদের দেশে। শ্রেষ্ঠী এবার তাদের সঙ্গেও বানিজ্য-সম্পর্ক তৈরি করতে চান। লঙ্কাদ্বীপ থেকে ফেরার পথে, কন্যাকুমারিকার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাঁর নৌবহর তাই এবার দুইভাগে ভাগ হবে। একদল পরিচিত পূর্বমুখী পথ দিয়ে যাবে ঘরের পানে, আরেকদল পাড়ি দেবে উত্তর- পশ্চিমদিকে, নতুনের টানে। ভারতভূমির তটরেখা বেয়ে বেয়ে তারা পেরিয়ে চলবে ত্রিবাঙ্কুর, পেরিয়ে চলবে মহীশূর। তারপর একদিন হয়তো সূর্যাস্তের মুখে, ভৃগুকচ্ছের উপসাগরের দক্ষিণে সেই সাতটি ক্ষুদ্র দ্বীপে এসে পৌঁছাবে তারা। পশ্চিমী শ্বেতকায়দের উপনিবেশ সেখানেই। অঞ্চলটায় সমুদ্র শান্ত, অর্ণবপোতগুলি নিশ্চিন্তে আশ্রয় নিতে পারে। তাই বিদেশী নাবিকগুলি তাদের মাতৃভাষায় এর নাম দিয়েছে বম-বে, ভালো উপসাগর।
একদিন সন্ধ্যাবেলায় শান্ত শীতলক্ষ্যায় আচমকা ঢেউ ওঠে। মোচার খোলার মত দুলতে থাকে মাছ ধরার ডিঙ্গি নৌকাগুলো। মশালের আলোয় সরল জালুকেরা একে অপরের দিকে তাকায়। কিকারণে এই হঠাৎ উন্মাদনা, বুঝে উঠতে পারে না তারা। অলক্ষ্যে মৃদু হেসে নতুন ইতিহাস রচনা করেন মহাকাল।
নদীর বুকে অবিরাম বয়ে চলা চিরকালীন সেই ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখতে শীতলক্ষ্যার তীরে একদিন আমায় পৌঁছতেই হবে, রাজ ভাই।
[১২/০৯/২০১৭ তারিখে লেখা রাজ ভাইয়ের চিঠিঃ
প্রিয় নির্মাল্য,
শীতলক্ষ্যার তীর থেকে আপনাকে লিখছি। আপনি সমুদ্রের মানুষ, উত্তাল ঢেউকে বশ মানিয়ে আপনার কর্মক্ষেত্র। সেই আপনাকে আমি সামান্য এক নদীর কথা বলছি, এ আমার পক্ষে চরম ধৃষ্টতা! তবে আপনি গল্প শুনতে ভালোবাসেন, একারণেই সাহসটুকু পেলাম।
আমি জানি অন্য পাঁচজন যে ভংগিতে দেখে আপনি ঠিক সেভাবে দেখেন না। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি আরো স্বচ্ছ, গল্পের পিছনের গল্পকে আপনি দেখতে পান। আচ্ছা ব্রহ্মপুত্রের এই শাখাকে আপনি কিভাবে দেখবেন?
শীতলক্ষ্যা সবসময়েই শান্ত এক জলধারা। ঢাকার পৌনে দু'কোটি মানুষের বিষ বয়ে নিয়ে চলেছে সে। তারপরও দেখা যায় কতোগুলো কচুরিপানা জমেছে তার বুকে। অনেকগুলো রাজহাঁস ডানা ঝাপটায় সেখানে। বিশাল বিশাল নৌযান তার কালো বুককে চীরে দিয়ে যাচ্ছে। তবুও শীতলক্ষ্যা শান্ত। সত্যি বলছি, বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলগুলোর গুদামে দাড়িয়ে শান্ত এই নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে একটুও খারাপ লাগেনা। ঢাকার সুপেয় পানির বড় যোগানদাতা এই শীতলক্ষ্যা।
তবে আপনি কিভাবে এই নদীকে দেখবেন তা আমি জানি। পৃথিবীর সবচেয়ে শৈল্পিক শিল্পের জননী হচ্ছে এই নারী। জামদানী...
জামদানী শুধুমাত্র এই শীতলক্ষ্যার তীরেই হয়। শীতলক্ষ্যার আবহাওয়া জামদানীর সুতোকে জামদানীর উপযোগী করে তোলে। এখানকার বয়নশিল্পের ইতিহাস কতো পুরানো তা কে জানে! বোধহয় শীতলক্ষ্যার মতোই প্রাচীনা।
প্রত্যেকটা বাংগালী নারীর একটি পরম আরাধ্য হচ্ছে তার জীবনে কমপক্ষে একটা জামদানী শাড়ি। একজন নারী তার সীতাহারকে যেভাবে যত্নে রাখে ঠিক সেভাবেই যত্নে রাখে তার জামদানীকে।
ছোটবেলায় আমার মাকে দেখেছি আফসোস করতে, ইশ! তার যদি একটা জামদানী থাকতো! এখন তার ওয়ারড্রোভের বড় অংশটা জুড়েই জামদানী।
আমার বড়মামী শাড়ি পড়তে খুবই পছন্দ করেন। কোন একটা উপলক্ষ্য পেলেই তিনি শাড়ি কিনে আনেন। আমি দেখেছি তার আলমারির সবচেয়ে দামী শিফনকেও ম্লান করে দেয় সবচেয়ে কমদামী জামদানীটি।
আমার মেজমামী শাড়ি সামলাতে পারেন না। তাকে খুব কমই দেখেছি শাড়ি পড়তে। তবে প্রায় প্রায়ই দেখি তিনি তার জামদানীগুলো রোদে মেলে দিয়েছেন। তারপর সন্ধ্যাবেলা সেগুলো পরম যত্নে ভাজ করে ন্যাপথলিন দিয়ে ড্রয়ারে রেখে দিচ্ছেন।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বেশিরভাগ সময় দেখেছি জামদানী পড়তে। তিনি বয়সোপযোগী রুচীশীল জামদানী পরেন সবসময়। তার মেয়ে-জামাই যে তাকে একটা জামদানী উপহার দিয়েছে এ বিষয়ে একদিন সংসদে বক্তব্যও দিয়েছিলেন তিনি।
একটা ঘটনা আমি সবাইকে গর্ব করে বলি। একদিন কলকাতায় গড়িয়াহাট মোড়ে দাড়িয়ে ছিলাম বাসের অপেক্ষায়। এসময় দুজন পৌড় ভদ্রমহিলা হেটে যাচ্ছিলেন আমার পাশ দিয়ে। হাটতে হাটতে তারা হঠাত দাড়িয়ে পড়লেন। আমি খেয়াল করে দেখলাম তাদের চোখ একটা শাড়ির দোকানের ডিসপ্লেতে আটকে গিয়েছে। সেই ডিসপ্লেতে একটা ঢাকাই জামদানী তার সমস্ত রং নিয়ে ঝলমল করছে। আমি এই বয়স্কা ভদ্রমহিলাদের যে অভিব্যাক্তি দেখলাম তা হচ্ছে বিষ্ময়, তৃপ্তি আর আফসোস। বিষ্ময়ের কারণ হচ্ছে জামদানীটির সৌন্দর্য আশেপাশের সব শাড়িকে তুচ্ছ করে দিচ্ছে। তৃপ্তির কারণ হচ্ছে এই অসাধারন বর্ণিল আলোকজ্জ্বল শিল্পকর্মটি দেখার সৌভাগ্য তাদের হয়েছে। আফসোসের কারণ হচ্ছে তাদের কারো ভান্ডারেই সত্যিকারের ঢাকাই জামদানী নেই। প্রায় দশ মিনিট ধরে দাড়িয়ে তারা শাড়িটি মুগ্ধ চোখে দেখলেন আর আলোচনা করলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার গন্তব্যে রওনা দিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি অনুধাবন করলাম কলকাতার মানুষেরা যেরকম পদ্মার ইলিশ ভালোবাসে ঠিক একইভাবে সেখানকার নারীরা জামদানী ভালোবাসে।
কোন কুমারী মেয়ে যখন জামদানী পরে কুচি হয় ছয়টা। তার শাড়ির আচল থাকে বড়। বিয়ের পর এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার কুচি কমতে থাকে আর আচলে টান পড়তে থাকে। তবুও জামদানী থেকে যায় সেই একই রকম নূতন।
আজ শীতলক্ষ্যার তীরে জামদানী পল্লিতে গিয়েছিলাম। মসলিনের একটা জামদানী দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো সেসময়। চোখ ধাঁধানো তার রূপ। সূক্ষাতীসূক্ষ কারুকাজ তার। অর্ধ শতক পুরানো এই বস্ত্রখন্ডের মূল্যমান অমূল্য। অনেকটা কোহিনূরের মতো। এটা একেবারেই বিক্রির জন্য নয়। আমার অপ্সরী ছোটমামী যখন এই শাড়িটি দু'ভাজ করে তার হাতের উপর মেলে ধরেছিলেন তখন এই মসলিনটি এতোটাই মিহি ছিলো যে দু'ভাজ ভেদ করে মামীর রক্তাভ ফর্সা হাতখানি দ্যুতি ছড়াচ্ছিলো। আফসোস! এইসব মসলিনের কোন তাঁতীই নাকি আর বেচে নেই। আর নাকি এরকম কারুকাজ করা সম্ভবও না।
আপনি হয়তো জানেন, জামদানী হচ্ছে মসলিনের একটা ধারা। আজকে আমার দেখা শাড়িটি ছিলো নাকি সবচাইতে নিকৃষ্ট মসলিন। হায়!! এটা যদি সবচেয়ে নিকৃষ্ট মসলিন হয়ে থাকে যার রূপের আলোকচ্ছটায় চোখ ঝলসে যাচ্ছিলো, তাহলে সুপ্রাচীন রোম, গ্রীস আর মিশরের নারীরা শরীরে যে মসলিন জড়াতো তার রূপ ঠিক কোন শীখরে উঠেছিলো!!!
নির্মাল্য, হয়তো শীতলক্ষ্যার তীর আপনার ভালো লাগবে। আমি আপনার অপেক্ষায় আছি...]