স্থবিরতার কাব্য

প্রস্তরমানুষ আমি, বুকে গাঁথা হয়
রক্তিম শিলালিপি, বয়ে যায় অনন্ত সময়
প্রতীক্ষায়

Wednesday, May 22, 2019

Robinson Crusoe-র জীবন

ক্লাস সেভেনে রবিনসন ক্রুশো আমাদের ইংরাজী র‍্যাপিড রিডার ছিল
প্রায় বিকেল হয়ে আসা দুপুরে, স্কুলবাড়ির একতলার কোণের ঘরে ইংরাজী স্যার আমাদের রবিনসন ক্রুশো পড়াতেন সামনের মাঠের ওপর রোদ পড়ে আসত আকাশে দেখতাম এক দুটো পাখি ঘুরে ঘুরে চক্কর কাটছে একটা কুকুর অলসভাবে শুয়ে আছে মাঠের মধ্যে মাঠের শেষে গাছেদের জটলা, ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সব সার বেঁধে স্যার পড়ে শোনাতেন, কিভাবে ক্রুশো দূর জনমানবশূন্য দ্বীপে একা একা খাবার জোগাড় করছে, পানীয় জল খুঁজছে, মাছ ধরছে
সেই কিশোরবেলায় কল্পনার পাখায় ভর করে উড়তে বেশ লাগত দূরের গাছের সারির দিকে তাকিয়ে ভেবে নিতাম, এই যেন ড্যানিয়েল ডিফোর গল্পে বর্ণিত সেই নির্জন দ্বীপের জঙ্গল এর মধ্যে একটা জাহাজডুবি মানুষ এসে উঠেছে  একেবারে একলা বেচারি, সঙ্গে কোনো আত্মীয় নেই, কোনো বন্ধু নেই
স্যারের গল্পে ক্রুশো একলা ঘরকন্না করতে শিখত, একলাই কুটির বানাত, একা একাই কিছু শাকসবজি, শস্যদানা চাষ করার চেষ্টা করত তখনকার অনুভূতিপ্রবণ মনে ক্রুশোর প্রতি মায়া হত, কষ্ট হত ইস্‌, সব কেমন একা-একা!
এখন প্রতিদিন চারপাশের মানুষ, প্রায়-মানুষগুলোর স্বরূপ বুঝতে বুঝতে, সভ্য-ভদ্র মুখোশের আড়ালে তাদের ঘৃণা- বিতৃষ্ণা জাগানো বিকৃত মুখগুলো চিনতে চিনতে ক্রমাগত ক্লান্ত হয়ে যখন চুপ করে বসে থাকি, তখন ক্রুশোর প্রতি ঈর্ষা হয় ইস্‌, সব কেমন একা-একা! 

Sunday, September 9, 2018

অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে...

প্রথম যখন তাঁকে দেখি, তখন সবথেকে বেশী নজর কেড়েছিল তাঁর চোখদুটো। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি-- কথাটা আগে বইয়ের পাতায় পড়া থাকলেও, এই প্রথম দেখলাম তা বলতে কি বোঝায়। আর দেখলাম, সবসময় তাঁর চোখদুটো কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে; এই ঘরভর্তি লোক, ক্যামেরার মুহুর্মুহু flash- ঝলকানি-- এসব কিছুই সেই অবিরত অনুসন্ধানকে এক চুল বিব্রত করতে পারছে না। ্তখন আমার নবম শ্রেণী; তাঁর লেখা কবিতা সেভাবে পড়ে ওঠা হয়নি তখনও; পাঠ্যবইয়ের রবীন্দ্রনাথ, সুকান্ত, জীবনানন্দ-- এঁদের নামই কবি হিসাবে তখন পরিচিত আমাদের কাছে। তবে তাঁর একটি উপন্যাস হাতের কাছে পেয়ে পড়ে ফেলেছি; অল্পবয়সে উপন্যাসের অন্তরের কথা তত বুঝতে না পারলেও, লেখার ধরণ মুগ্ধ করেছে আমাকে। কল্পনায় আমি দেখতে পেয়েছি কলকাতা থেকে কিছু দূরে, রেলরাস্তার ওপারের সেই শান্ত মফস্বল শহরটিকে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, জোনাকি-জ্বলা মাঠের মধ্যে একটি বাড়ি; আর সেই বাড়ির অন্ধকার দরজায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে প্রদীপের মত একটি মেয়ে। অবাক হয়ে অনুভব করেছি, উপন্যাসের সাজানো অক্ষরগুলোর আড়াল থেকে যেন উঁকি দিচ্ছে একটি নিটোল কবিতা। এমনও লেখা যায় তাহলে! সেই উপন্যাস নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হলেও, সাহস হয়নি; আর সময়ও ছিল অল্প। বাস্তবিকই, একটা school exhibition-এ তিনি আর কতটুকু সময় দিতে পারেন। তবুও দ্রুত সব কিছু ঘুরে দেখে শেষে যখন তিনি চলে যাবার উপক্রম করলেন, তখন সবার দেখাদেখি আমিও সই নেবার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম; হাতে কোনো দামী অটোগ্রাফ-ডায়েরি নয়, খাতার পেছন থেকে ছিঁড়ে নেওয়া একটুকরো কাগজ মাত্র। কাগজটা নিয়ে তিনি স্থিরভাবে আমার দিকে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত; ওই যে বলেছিলাম, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি-- সেই চোখে। আমার মনের ভেতরের সব কথা তিনি যেন পড়তে পারছেন। তারপর কাগজটায় লিখে দিলেন-- "জয় জেঠুর সই, হারিয়ে ফেলবই।" তার নীচে সই করলেন নাম।

সেই কাগজ এখন কোথায়, সে খবর জানতে চাইলে লজ্জা পাব। কারণ, জয় গোস্বামী-র সেই মূল্যবান সই, আমি অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি। 

Saturday, March 17, 2018

ভৈরবী

ভোর হচ্ছে। মায়াবী আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে-- 'আলপনা দ্যায় আলতো বাতাস, ভোরাই সুরে মন ভোলা'।
আরেকটা দিনের শুরু-- রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যাকে বলেছিলেন, 'ক্লান্তিকর আমাদের দৈনন্দিন দিন'। দিনগত পাপক্ষয়।
'ভেবেছিলাম নিচু করবো না মাথা, তবুও ভেতরের এক কুত্তার বাচ্চা
মাঝে মাঝে মসৃণ পায়ের কাছে ঘষতে চায় মুখ
এ-সব ইয়ার্কি আর কদ্দিন হে?
শুধু বেঁচে থাকতেই হালুয়া টাইট করে দিচ্ছে
অথচ কথা ছিল, সব মানুষের জন্য এই পৃথিবী সুসহ দেখে যাবো'


তবু ভোর ক্লান্তির বার্তা দেয়না কখনো। ভোর শোনায় শুদ্ধতার সুর। ব্রাহ্মমুহূর্ত-- কথাটার মধ্যে একটা নিষ্কলুষ পবিত্রতা রয়েছে। ঋষিরা এসময় সূর্য প্রণাম করতেন--
'ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশ্যং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্‌
ধ্বন্তারিং সর্ব্বোপাপোঘ্নং প্রণতোস্মি দিবাকরম্‌'
--জবাফুলের ন্যায় রক্তিম এই প্রভাতসূর্য, যাঁর পবিত্র দ্যুতি মন থেকে সব পাপভাব দূর করে, তাঁকে আমরা প্রণতি জানাই--
ঋষিরা আর নেই। তবে একজন মহর্ষি আছেন, থাকবেন। তাঁর বীণায় বেজে ওঠে সুর--
'নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলই করি অপমান,
আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে'
-- বার বার এই চরণ দুটি বাজতে থাকে, আর এই ভোরের শিশিরে জীবনানন্দের সবুজ ঘাসের মতই ভিজে যায় আমার দুই চোখ।
'নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলই করি অপমান'--

এই অপার্থিব ভোরে, খুব ইচ্ছা করে, এই সদ্যোজাত আলোর শুভ্রতায় মুছে ফেলি এইসব অপমান- ব্যর্থতা-তুচ্ছতা-সংকীর্ণতা-পাপ-দুঃখের কালিমা। একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠি--'ইতি তোমার মা'-য়ের মহারাজ যেমন বলেছিলেন, 'নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত'-- তেমন একজন মানুষ। যে মানুষ বলতে পারে--
''ন মে দ্বেষরাগৌ ন মে লোভমোহঃ, মদ নৈব মে নৈব মাত্সর্যভাবঃ,
ন ধর্ম ন চ অর্থ ন কাম ন মোক্ষঃ, চিদানন্দরূপঃ শিবোহং শিবোহম'
-- আমার দ্বেষ বা রাগ নাই; আমার লোভ বা মোহ নাই; আমার অহঙ্কার বা ঈর্ষা নাই; আমার ধর্ম, অর্থ, কাম বা মোক্ষের তৃষ্ণা নাই; আমি পরম আনন্দ স্বরূপ সত্য সুন্দর পবিত্রতা।

জানি, ভোরের এই শুভ্র সংকল্প দ্রুত মলিন হয়ে যাবে। সময় এগিয়ে চলবে, রুক্ষ বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। সাক্ষাৎ গড়াবে সংঘর্ষে--'পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার'-- দিনশেষে আহত, ক্লান্ত, অপমানিত হয়ে ফিরে আসা, ক্ষণিক বিশ্রামের আশায়। এই যুদ্ধ জন্ম থেকেই চলছে; 'জন্মই আমাদের আজন্ম পাপ'। এই যুদ্ধের শেষ নেই, শেষ হয়না কখনো। তবু ভোর আসবে আবার। আবার আসবে সেই মুহূর্ত-- 'we live in moments, not in years'-- যেই মুহূর্তে আকাশে-বাতাসে আবার অণুরণিত হবে সেই মহাবাণী--
'শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা, আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূ ।
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্‌, আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ
ত্বমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি, নান্যঃপন্থা বিদ্যতেহয়নায়'
-- 'হে বিশ্বমানব, শোনো, তোমরা অমৃতের সন্তান। সেই মহান পুরুষকে জানো, যিনি তমসা ভেদ করে জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি, মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারো, অন্য পথ নাহি--'
-- আগামীকাল আবার সেই শাশ্বত ঊষালগ্নের পবিত্র স্পর্শ নতুন করে পাওয়ার জন্যই, বোধহয় আজকের দিনটা বেঁচে থাকা যায়।

Friday, March 2, 2018

ভালো লাগা কবিতাঃ আমি এই। সুনীল বসু


আমি এই। সুনীল বসু

তুমি কি করছ ভূতনাথ? লিখছ টিখছ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সত্যিই শুভাশিস, আমি গাড়ি কিনতে পারিনি, না করেছি বাড়ি
জননেতা কোন্‌ দূর, জনতার দৈত্যের হাত থেকে পালিয়ে গিয়েছি
কলকাতা থেকে কিছু দূরে আধা পাড়াগাঁয়ে,
রাত ভোর হলে কলাগাছের পাতায় শিশির ঝরা দেখি,
ওতেই শিহরণ খেলে যায়।
সেই কবে এক রুগণ কবিতার নারীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে অবধি  
খরচের আর শেষ নেই,
রাত্রে গিয়ে ঠায় বসে থাকি তারার বাগানে।
গুড়গুড় করে মেঘ ডেকে উঠলে বুকের মধ্যে হই হই করে শুনি
ভাস্কো দা গামার পালতোলা জাহাজের কামানগর্জন।
বিদ্যুৎ চমকালে দেখি শেক্সপীয়রের নাটকের বীভৎস বুড়ি ডাইনিদের চুল ছেঁড়াছিঁড়ি,
লম্বা লম্বা নখের বাহার।
ঘরে বসে জানি না আকাশকে কেন দেখি ভূমধ্যসাগর--  
এক এক দিন মাঘী পূর্ণিমায় দেখি সাদা ফেনায়িত প্রকাণ্ড আকাশব্যাপী রাজহাঁস--
ফেলে যায় নিটোল টলটলে সোনার ডিম।  
শুভাশিস, গাড়ি কিনতে পারিনি, করতে পারিনি বাড়ি, জননেতা হওয়া অসম্ভব।
শুধু ছোট ছোট কল্পনার লাল ইঁট গাঁথি,
আর চুরমার করি।
কিছুই হওয়া হয়নি। ট্রেনে করে আসি আর যাই।
রুগণ কবিতার-নারীর চিকিৎসায় আমি ফতুর হয়ে গেলাম। হয়তো জীবনই চলে যাবে...
তোমরা বেশ আছ! শুভাশিস, সুনন্দ, আশুতোষ...

আমি এই।  

Tuesday, February 27, 2018

আজ আগমনীর আবাহনে

(১৫/১০/২০১২)
আজ মহালয়া। দেবীপক্ষের শুভ সূচনা। আজ আগমনী।
ইস্কুলে পড়ার সময় আজকের দিনে আমরা সকালের প্রেয়ারে একটা গান গাইতাম।
প্রেয়ার হল এর ধূপের সেই মন ভালো করে দেওয়া গন্ধটা, পদ্মফুলের আধফোটা কুঁড়ি,
আর পুজোর শেষের সেই ছাপ আঁকা সন্দেশ ....
বড় হয়ে ওঠার পাকদন্ডী পথের ঠিক কোন বাঁকটায় যে সেগুলোকে হারিয়ে ফেললাম....
.........................
যাক। থাক আজ এসব কথা। আজ আর কোনো আপশোষ নয়। নয় কোনো পেয়ে হারানোর চাপা কষ্ট।
আজ হাসিমুখ। আজ কিসের দুঃখ ! আজ যে মা আসার দিন গোনাশুরু ! জানি, আরো সাত সাতটা দিন। তবে, এও জানি, দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
একটা বছর ধরে অনেক তো হলো এসাইনমেন্ট, মিড সেমিস্টার আর প্রোজেক্ট রিপোর্ট। অনেক হলো। অনেক শিখলাম, অনেক জানলাম। জানলাম কত কিছু এখনো শেখা বাকি। কটাদিন এখন থাক না ওসব।
এবার ঘরে ফিরব।
মা ডাকছেন যে।
ঘরেতে মৃন্ময়ী মা, মন্ডপে চিন্ময়ী মা। তবে আমাদের মৃন্ময়ীতেই চিন্ময়ী।
গানটার কথা বলছিলাম না? গান তো নয়, ওটা একটা ছবি। ক্লাস সিক্স এর সুনীতি স্যার এর ভাষায়, চিত্রকল্প।
প্রার্থনাগৃহের বাটে আমার পায়ের চিহ্ন অনেকদিন পড়েনি। হারমোনিয়াম এর রিডগুলো বহুদিন ব্যবহার না হতে হতে অকেজো।
বাঁশি বাজাতে....জানতাম নাকি? মনে পড়েনা।
কিছুই মনে পড়েনা।
গানটা কিন্তু, আজও মনে আছে।
ওই গানটা ছাড়া দুগ্গা পুজো ভাবতে পারি না। যখন তখন দিনদুপুরে অকাল আঁধার, বুক-কেমন-করে-ওঠা বিজলী-উজল আলো, আর কারণে অকারণে অঝোরধারায় জনমদুখিনি মেঘবালিকার চোখের জল ---
দিনের পর দিন মন-খারাপ-করা বিকেলগুলোতে ঘরে বসে বসে যখন চন্ডীদাস এর বিলাপ এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে থাকি, তখন হঠাৎ একদিন সকালে অস্কার ওয়াইল্ড এর গল্পের মত জানালা দিয়ে দেখি, আরে ! কান্না থেমে গেছে , বদলে নরম সাদা কাশফুল গুলোর পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে সকালবেলার মিঠে সূর্য। এই সুন্দর গন্ধটা শিউলির না ! গাছটা কোনদিন যে ফুলে ফুলে ভরে উঠলো, খেয়ালই করিনি ! মাঠে মাঠে সোনারঙের ধানগুলো কি এক আনন্দে মাথা দুলিয়েই চলেছে...
আর, তখনই গানটা মনে পড়ে যায়।
এক বুক আনন্দ নিয়ে দেখি, রাঙামাটির পথ বেয়ে অচিনগাঁয়ের বাউল ওই গানটাই গেয়ে গেয়ে ফিরছে......
আজ আগমনীর আবাহনে কি সুর উঠেছে বেজে
দোয়েল শ্যামা ডাক দিল তাই বরণের এয়ো সেজে ৷
ভরা ভাদরের ভরা নদী কুলুকুলু ছোটে নিরবধি
সে সুর গীতালি দেয় করতালি নাচে তরঙ্গ দোলনে রে ৷
পূরব দীপক আরতির দীপ শত ছটা মেঘ জালে
দিকবালা তায় আলতা গুলেছে রক্ত-আকাশ থালে ৷
ঘাসের বুকেতে শিশির নীর ধোয়াবে ও রাঙ্গা চরণ ধীর
সবুজ আঁচলে মুছে নেবে বলে ধরণী শ্যামলা সেজেছে রে........
সবাইকে জানাই শুভ মহালয়ার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা....৺আনন্দময়ীর আগমনে বিশ্বমানবের জীবন হয়ে উঠুক আনন্দমুখর....এই একান্ত প্রার্থনা ।

Sunday, February 25, 2018

কিশোরী আমোনকরের প্রয়াণে

(০৫/০৪/২০১৭)

ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখি আকাশের মুখ থমথমে, যেন উদ্গত অশ্রু চেপে রেখেছে। নিউজফিড খুলে দুটো খবর পাই। প্রথম খবর, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিষাক্ত গ্যাসে মারা গেছে অন্ততঃ ৭২ জন। ১১টা বাচ্চা আছে তাদের মধ্যে, যারা গ্যাসের মারণ ছোবলে ছটফট করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। পৃথিবী তার সমস্ত সৌন্দর্য-শ্যামলিমা -সৌকর্য নিয়ে তাদের বড় হয়ে ওঠার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু তার আগেই তারা জেনে গেল বিশ্বের তথাকথিত শ্রেষ্ঠ প্রাণীটি সময় বিশেষে কতটা ঘৃণ্য, কতটা নির্মম হয়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয় খবর, কিশোরী আমোনকর মারা গেছেন। বয়স হয়েছিল জানতাম, তবে অসুস্থতার তেমন কোনো খবর শুনিনি, ফলে সংবাদটি হজম হতে একটু সময় লাগে। গুণী চলে যান, তাঁর গান রয়ে যায়। ইউটিউবে খুঁজে পাই তাঁর সুর, কানে বাজতে থাকে চিরপরিচিত অথচ চিরনতুন সেই মল্লার-বন্দিশ —
“উমড় ঘুমড় গরজ গরজ 
বরষণ কো আয়ো মেঘা 
এইসো হি ঝনন লাগে 
পিয়া বিন মোরে নয়না ...”
ঠিক তখনই, আবহমান কাল ধরে চলে আসা মানুষের সমস্ত সঙ্কীর্ণতা, নির্মমতা, অবিচারের প্রতি অব্যক্ত বেদনা নিয়ে একফোঁটা জল আকাশ থেকে ঝরে পড়ে। আমি বুঝতে পারি, এই পৃথিবী আর কিশোরী আমোনকরদের বাসযোগ্য ছিল না।

চিঠি, রাজ ভাইকে...

(১৩/ ০৯/ ২০১৭)
প্রিয় রাজ ভাই,
পত্র-সাহিত্য বলে বাংলা সাহিত্যের একটি ধারা ছিল, যা এখন বিলুপ্ত। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ইত্যাদি মনীষীদের পুস্তকাকারে প্রকাশিত পত্রাবলী পড়ে দেখেছি, স্বভাবসিদ্ধ বাগ্‌চাতুর্যের সঙ্গে ঘরোয়া সহজ-সরসতার মিশেলে সেই লিপিগুলি বড়ই সুপাঠ্য ছিল। দুঃখের বিষয় এই যে, নিতান্তই কেজো ‘বিজনেস লেটার’ ছাড়া, চিঠি আমরা আর লিখিনা; লাল ডাকবাক্স আর তকমা আঁটা পিয়নের উৎসুক প্রতীক্ষায় থাকার সেই দিনগুলি আমরা পিছনে ফেলে এসেছি, অথবা বলা ভাল তারাই অভিমানে আমাদের ছেড়ে দূরে সরে গেছে। আপনার সুলিখিত পত্রটি আমাকে সেই হারিয়ে যাওয়া সোনালী অতীতের কথা মনে করিয়ে দিল। 
শীতলক্ষ্যা নামটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আমি ঠিক জানিনা। তবে প্রথম যখন এই নামটি শুনেছিলাম, আমি দেখতে পেয়েছিলাম শীতল এক আঁখিজোড়া। আয়তবিস্তৃত সকরুণ সেই নয়নযুগল যেন আমাকে আশ্রয় নিতে ডাকছে। আমার মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে যে নামটি আমার মনে আসে, তা হল শীতলক্ষ্যা। শীতলক্ষ্যারা চিরকালই আমাদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় দিয়ে এসেছে; আমাদের শান্ত করেছে, শীতল করেছে। 
আপনার চিঠিটি পড়তে পড়তে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এক বিস্তীর্ণ নদীর দৃশ্য। কৃষ্ণবর্ণ নয়, কাকচক্ষু নির্মল তার জল। সকাল হচ্ছে, কুয়াশার জাল কেটে নবীন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। রাজহংসেরা গ্রীবা বাঁকিয়ে ভেসে চলেছে। চঞ্চল ছেলের দল জলে ঢেউ তুলে সাঁতার কাটছে, ঘাটে স্নান করতে এসেছে গ্রামবধূরা। নদীর বুকে ইতস্ততঃ ভাসছে বেশ কয়েকটি বহিত্র। চট্টগ্রাম, সপ্তগ্রাম, তাম্রলিপ্ত—বঙ্গদেশের প্রসিদ্ধ সব বন্দরনগর থেকে এসেছে সেগুলি। ছোটো ছোটো নৌকায় করে বহিত্রগুলিতে বোঝাই হচ্ছে বহুবর্ণের বিচিত্র সব পরিধান। এক হাতের মুঠোয় একটি প্রমাণাকার বস্ত্রখন্ডকে ভরে তার পেলবতা পরখ করে দেখছেন এক প্রবীণ শ্রেষ্ঠী। পাশে বসা তাঁর নবীন পুত্রের চোখে অপার বিস্ময়। পরিধেয় বস্ত্র এত সূক্ষ্ম হতে পারে! অভিজ্ঞ শ্রেষ্ঠী সন্তুষ্টিতে মাথা নাড়তে নাড়তে হাসছেন। এ হল পূর্বদেশের মসলিন। প্রত্যেকটি বস্ত্র বড় মূল্যবান। কয়েকটি তো অমূল্য। এই রত্নভান্ডার নিয়ে তিনি পাড়ি দেবেন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ উত্তাল সমুদ্র। লঙ্কাদ্বীপ, যবদ্বীপ, শ্যামদেশ, সুবর্ণভূমি – সর্বত্র সমাদর পায় এই আশ্চর্য বস্ত্র। পর্যাপ্ত স্বর্ণমুদ্রা পাবেন বিনিময়ে, সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত তিনি। তবে মনে তাঁর উত্তেজনা অন্য একটি কারণে। পরিচিত বাণিজ্যপথ ছেড়ে তিনি এবার পাড়ি দিতে চান নতুন সম্ভাবনার উদ্দেশ্যে। তিনি শুনেছেন, গান্ধার-পারস্য পেরিয়ে যে সুদূর পশ্চিমদেশ, সেখান থেকে জলপথে এসে ভারতভূমিতে উপনিবেশ স্থাপন করেছে কিছু শ্বেতকায় ধূসরচক্ষু নৌ-বণিক। মসলিন বস্ত্র, মাণিক্যের কণ্ঠহার, গজদন্তের পেটিকা--বহুরত্নপ্রসূ জম্বুদ্বীপের প্রত্যেকটি বিলাসদ্রব্য তারা আশাতীত মূল্যে ক্রয় করে, তারপর বিচিত্রদর্শন নৌ-যানগুলিতে বোঝাই করে সেসব তারা পাঠিয়ে দেয় তাদের দেশে। শ্রেষ্ঠী এবার তাদের সঙ্গেও বানিজ্য-সম্পর্ক তৈরি করতে চান। লঙ্কাদ্বীপ থেকে ফেরার পথে, কন্যাকুমারিকার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাঁর নৌবহর তাই এবার দুইভাগে ভাগ হবে। একদল পরিচিত পূর্বমুখী পথ দিয়ে যাবে ঘরের পানে, আরেকদল পাড়ি দেবে উত্তর- পশ্চিমদিকে, নতুনের টানে। ভারতভূমির তটরেখা বেয়ে বেয়ে তারা পেরিয়ে চলবে ত্রিবাঙ্কুর, পেরিয়ে চলবে মহীশূর। তারপর একদিন হয়তো সূর্যাস্তের মুখে, ভৃগুকচ্ছের উপসাগরের দক্ষিণে সেই সাতটি ক্ষুদ্র দ্বীপে এসে পৌঁছাবে তারা। পশ্চিমী শ্বেতকায়দের উপনিবেশ সেখানেই। অঞ্চলটায় সমুদ্র শান্ত, অর্ণবপোতগুলি নিশ্চিন্তে আশ্রয় নিতে পারে। তাই বিদেশী নাবিকগুলি তাদের মাতৃভাষায় এর নাম দিয়েছে বম-বে, ভালো উপসাগর। 
একদিন সন্ধ্যাবেলায় শান্ত শীতলক্ষ্যায় আচমকা ঢেউ ওঠে। মোচার খোলার মত দুলতে থাকে মাছ ধরার ডিঙ্গি নৌকাগুলো। মশালের আলোয় সরল জালুকেরা একে অপরের দিকে তাকায়। কিকারণে এই হঠাৎ উন্মাদনা, বুঝে উঠতে পারে না তারা। অলক্ষ্যে মৃদু হেসে নতুন ইতিহাস রচনা করেন মহাকাল।
নদীর বুকে অবিরাম বয়ে চলা চিরকালীন সেই ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখতে শীতলক্ষ্যার তীরে একদিন আমায় পৌঁছতেই হবে, রাজ ভাই।

[১২/০৯/২০১৭ তারিখে লেখা রাজ ভাইয়ের চিঠিঃ
 প্রিয় নির্মাল্য,

শীতলক্ষ্যার তীর থেকে আপনাকে লিখছি। আপনি সমুদ্রের মানুষ, উত্তাল ঢেউকে বশ মানিয়ে আপনার কর্মক্ষেত্র। সেই আপনাকে আমি সামান্য এক নদীর কথা বলছি, এ আমার পক্ষে চরম ধৃষ্টতা! তবে আপনি গল্প শুনতে ভালোবাসেন, একারণেই সাহসটুকু পেলাম।
আমি জানি অন্য পাঁচজন যে ভংগিতে দেখে আপনি ঠিক সেভাবে দেখেন না। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি আরো স্বচ্ছ, গল্পের পিছনের গল্পকে আপনি দেখতে পান। আচ্ছা ব্রহ্মপুত্রের এই শাখাকে আপনি কিভাবে দেখবেন?
শীতলক্ষ্যা সবসময়েই শান্ত এক জলধারা। ঢাকার পৌনে দু'কোটি মানুষের বিষ বয়ে নিয়ে চলেছে সে। তারপরও দেখা যায় কতোগুলো কচুরিপানা জমেছে তার বুকে। অনেকগুলো রাজহাঁস ডানা ঝাপটায় সেখানে। বিশাল বিশাল নৌযান তার কালো বুককে চীরে দিয়ে যাচ্ছে। তবুও শীতলক্ষ্যা শান্ত। সত্যি বলছি, বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলগুলোর গুদামে দাড়িয়ে শান্ত এই নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে একটুও খারাপ লাগেনা। ঢাকার সুপেয় পানির বড় যোগানদাতা এই শীতলক্ষ্যা।
তবে আপনি কিভাবে এই নদীকে দেখবেন তা আমি জানি। পৃথিবীর সবচেয়ে শৈল্পিক শিল্পের জননী হচ্ছে এই নারী। জামদানী...
জামদানী শুধুমাত্র এই শীতলক্ষ্যার তীরেই হয়। শীতলক্ষ্যার আবহাওয়া জামদানীর সুতোকে জামদানীর উপযোগী করে তোলে। এখানকার বয়নশিল্পের ইতিহাস কতো পুরানো তা কে জানে! বোধহয় শীতলক্ষ্যার মতোই প্রাচীনা।
প্রত্যেকটা বাংগালী নারীর একটি পরম আরাধ্য হচ্ছে তার জীবনে কমপক্ষে একটা জামদানী শাড়ি। একজন নারী তার সীতাহারকে যেভাবে যত্নে রাখে ঠিক সেভাবেই যত্নে রাখে তার জামদানীকে।
ছোটবেলায় আমার মাকে দেখেছি আফসোস করতে, ইশ! তার যদি একটা জামদানী থাকতো! এখন তার ওয়ারড্রোভের বড় অংশটা জুড়েই জামদানী।
আমার বড়মামী শাড়ি পড়তে খুবই পছন্দ করেন। কোন একটা উপলক্ষ্য পেলেই তিনি শাড়ি কিনে আনেন। আমি দেখেছি তার আলমারির সবচেয়ে দামী শিফনকেও ম্লান করে দেয় সবচেয়ে কমদামী জামদানীটি।
আমার মেজমামী শাড়ি সামলাতে পারেন না। তাকে খুব কমই দেখেছি শাড়ি পড়তে। তবে প্রায় প্রায়ই দেখি তিনি তার জামদানীগুলো রোদে মেলে দিয়েছেন। তারপর সন্ধ্যাবেলা সেগুলো পরম যত্নে ভাজ করে ন্যাপথলিন দিয়ে ড্রয়ারে রেখে দিচ্ছেন।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বেশিরভাগ সময় দেখেছি জামদানী পড়তে। তিনি বয়সোপযোগী রুচীশীল জামদানী পরেন সবসময়। তার মেয়ে-জামাই যে তাকে একটা জামদানী উপহার দিয়েছে এ বিষয়ে একদিন সংসদে বক্তব্যও দিয়েছিলেন তিনি।
একটা ঘটনা আমি সবাইকে গর্ব করে বলি। একদিন কলকাতায় গড়িয়াহাট মোড়ে দাড়িয়ে ছিলাম বাসের অপেক্ষায়। এসময় দুজন পৌড় ভদ্রমহিলা হেটে যাচ্ছিলেন আমার পাশ দিয়ে। হাটতে হাটতে তারা হঠাত দাড়িয়ে পড়লেন। আমি খেয়াল করে দেখলাম তাদের চোখ একটা শাড়ির দোকানের ডিসপ্লেতে আটকে গিয়েছে। সেই ডিসপ্লেতে একটা ঢাকাই জামদানী তার সমস্ত রং নিয়ে ঝলমল করছে। আমি এই বয়স্কা ভদ্রমহিলাদের যে অভিব্যাক্তি দেখলাম তা হচ্ছে বিষ্ময়, তৃপ্তি আর আফসোস। বিষ্ময়ের কারণ হচ্ছে জামদানীটির সৌন্দর্য আশেপাশের সব শাড়িকে তুচ্ছ করে দিচ্ছে। তৃপ্তির কারণ হচ্ছে এই অসাধারন বর্ণিল আলোকজ্জ্বল শিল্পকর্মটি দেখার সৌভাগ্য তাদের হয়েছে। আফসোসের কারণ হচ্ছে তাদের কারো ভান্ডারেই সত্যিকারের ঢাকাই জামদানী নেই। প্রায় দশ মিনিট ধরে দাড়িয়ে তারা শাড়িটি মুগ্ধ চোখে দেখলেন আর আলোচনা করলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার গন্তব্যে রওনা দিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি অনুধাবন করলাম কলকাতার মানুষেরা যেরকম পদ্মার ইলিশ ভালোবাসে ঠিক একইভাবে সেখানকার নারীরা জামদানী ভালোবাসে।
কোন কুমারী মেয়ে যখন জামদানী পরে কুচি হয় ছয়টা। তার শাড়ির আচল থাকে বড়। বিয়ের পর এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার কুচি কমতে থাকে আর আচলে টান পড়তে থাকে। তবুও জামদানী থেকে যায় সেই একই রকম নূতন।
আজ শীতলক্ষ্যার তীরে জামদানী পল্লিতে গিয়েছিলাম। মসলিনের একটা জামদানী দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো সেসময়। চোখ ধাঁধানো তার রূপ। সূক্ষাতীসূক্ষ কারুকাজ তার। অর্ধ শতক পুরানো এই বস্ত্রখন্ডের মূল্যমান অমূল্য। অনেকটা কোহিনূরের মতো। এটা একেবারেই বিক্রির জন্য নয়। আমার অপ্সরী ছোটমামী যখন এই শাড়িটি দু'ভাজ করে তার হাতের উপর মেলে ধরেছিলেন তখন এই মসলিনটি এতোটাই মিহি ছিলো যে দু'ভাজ ভেদ করে মামীর রক্তাভ ফর্সা হাতখানি দ্যুতি ছড়াচ্ছিলো। আফসোস! এইসব মসলিনের কোন তাঁতীই নাকি আর বেচে নেই। আর নাকি এরকম কারুকাজ করা সম্ভবও না।
আপনি হয়তো জানেন, জামদানী হচ্ছে মসলিনের একটা ধারা। আজকে আমার দেখা শাড়িটি ছিলো নাকি সবচাইতে নিকৃষ্ট মসলিন। হায়!! এটা যদি সবচেয়ে নিকৃষ্ট মসলিন হয়ে থাকে যার রূপের আলোকচ্ছটায় চোখ ঝলসে যাচ্ছিলো, তাহলে সুপ্রাচীন রোম, গ্রীস আর মিশরের নারীরা শরীরে যে মসলিন জড়াতো তার রূপ ঠিক কোন শীখরে উঠেছিলো!!!
নির্মাল্য, হয়তো শীতলক্ষ্যার তীর আপনার ভালো লাগবে। আমি আপনার অপেক্ষায় আছি...]